আচার্য বিনোবা ভাবের দাবা খেলার সঙ্গী ছিলেন বাবা; দিব্যার জিনে রয়েছে দাবার প্যাশন, বলছেন মা!

স্বাধীনতা সংগ্রামী, ভূদান আন্দোলনের জনক, গান্ধিজীর ‘আধ্যাত্মিক উত্তরসূরী’ বিনোবা ভাবে নিয়মিত দাবা খেলতেন পনবর আশ্রমে। আর সেখানে তার অনেক সঙ্গীর মধ্যে একজনের নাম? দুর্গা প্রসাদ শর্মা। সদ্য মহিলা দাবার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন দিব্যা দেশমুখের প্রপিতামহ! দুর্গাপ্রসাদের নাতনি নম্রতা দেশমুখ। নাগপুরের চিকিৎসক। এখন তিনিও বিখ্যাত হয়েছেন মেয়ের খ্যাতিতে। কিন্তু মেয়ের খ্যাতিতে তার গর্ব যেন আরও বেড়ে গিয়েছে! তিনি ও দিব্যার বাবা-দুজনেই চাইতেন তাদের দুই মেয়েই দাবা খেলুক। চাওয়ার পেছনে কারণও ছিল। মেয়েদের জিনেও তো দাদুর দাবা খেলার ভালবাসার প্রভাব ছিল। বিশ্বজয়ের উত্তেজনা এখনও থিতিয়ে যায়নি। জর্জিয়ার লড়াইয়ে ভারতেরই কোনেরু হাম্পিকে পরাস্ত করে দেশে ফেরার পর নাগপুরে দিব্যাকে নিয়ে জমকালো উৎসব হয়েছে। ১৯ বছরের মেয়েটা জর্জিয়ার বাটুমিতে গিয়েছিলেন আন্ডারডগ হয়ে। সেখান থেকে চ্যাম্পিয়নের শিরোপা নিয়ে ঘরে ফেরা। নম্রতা দেশমুখ এই সাফল্যের আড়ালে পারিবারিক পূর্বসূত্র ও জিনের কারসাজি দেখছেন। দিব্যার কৃতিত্ব, তাঁর মায়ের চোখে, অনেকটাই পূর্বজদের কৃপা। দুর্গাপ্রসাদ যাঁর অন্যতম। খুশিতে ভরে ওঠা চোখে নম্রতা বলেছেন, “এটা ওর জিনেই রয়েছে। আমার মায়ের বাবা ডা. দুর্গাপ্রসাদ, আচার্য বিনোবা ভাবের অনুগামী, ছিলেন দাবার পরম অনুরাগী। প্রতি শনিবার তাঁরা পনবর আশ্রমে খেলতে বসতেন!” নম্রতা ও তাঁর স্বামী জীতেন্দ্রর খুব ইচ্ছে ছিল, তাঁদের দুই কন্যা দাবা শিখুক। প্রথম মেয়ে আর্যা এই পথে এগতে চাননি। বদলে বেছে নিয়েছেন বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন। ছোট মেয়ে দিব্যা পেয়েছেন দুর্গাপ্রসাদের ধাত। নাগপুরের শঙ্কর নগরের কলোনির রাহুল যোশীর অ্যাকাডেমিতে হাতেখড়ি। তারপর ধাপে ধাপে উত্থান। ছয় পেরিয়ে সাতে পা রেখেছেন যে বছর, সেই ২০১২ সালে অনূর্ধ্ব-৭ জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে নাম লেখান দিব্যা। আর ঘরে ফেরেন পদক জিতে। প্রথম বড় টুর্নামেন্ট। আর শুরুতেই বাজিমাত! এরপর ২০১৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে আয়োজিত অনূর্ধ্ব–১০ বিশ্বখেতাব, ২০১৭-তে ব্রাজিলে অনূর্ধ্ব–১২ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জয়… উড়ান ছিল বাধাহীন, সাবলীল। প্রভূত সাফল্যের জেরে খুব অল্প বয়সেই অর্জন করেন মহিলাদের ফিডে মাস্টার (WFM) খেতাব। ২০২১-এ গ্র্যান্ডমাস্টার (WGM)। বিদর্ভ অঞ্চলের প্রথম দাবাড়ু হিসেবে এই স্বীকৃতি অর্জন করেন দিব্যা দেশমুখ। সেই সঙ্গে ভারতের ২২তম মহিলা গ্র্যান্ডমাস্টার হিসেবে রেকর্ড বুকে নাম লেখান। বছর দুই বাদে হাতে ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার (IM) উপাধি। ২০২৪-এ দাবার জগতে সামনের সারিতে এনে এনে দেয় বিশ্ব জুনিয়র (অনূর্ধ–২০) গার্লস চ্যাম্পিয়নশিপ জয়। সেই অভিযান তিনি শেষ করেন অবিশ্বাস্য স্কোরে—১১ গেমে ১০ পয়েন্ট! স্রেফ চোখধাঁধানো সাফল্য নয়, ধারাবাহিকভাবে ভাল ফর্ম ধরে রাখাই দিব্যাকে বাকিদের থেকে আলাদা করে তুলেছে। ২০২৪-এর ৪৫তম দাবা অলিম্পিয়াডে ভারতের মহিলা দলের সোনাজয়ী সদস্য ছিলেন। দলের জয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। একই বছর ওয়ার্ল্ড টিম র্যাপিড অ্যান্ড ব্লিট্জ চ্যাম্পিয়নশিপে তাঁর পারফরম্যান্স রেটিং ২৬০০-র ওপরে ওঠে, যা এক কথায় অবিশ্বাস্য! দিব্যার ঝুলিতে ইতিমধ্যে এসেছে: তিনটি দাবা অলিম্পিয়াড সোনা, একাধিক এশীয় ও বিশ্ব বালিকা দাবা খেতাব, বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে বিশ্ব এক নম্বরকে হারানোর অভিজ্ঞতা। চেন্নাইয়ের চেস গুরুকুলে গ্র্যান্ডমাস্টার আরবি রমেশের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নেন দিব্যা। তাঁর খেলার ধরন রীতিমতো ছকভাঙা। বয়স আঠারো হলেও পরিকল্পনায় পরিণতির ছাপ স্পষ্ট। চাল দেওয়ার শৈলী আগ্রাসী হলেও অহেতুক ঝুঁকি নিতে নারাজ। তীক্ষ্ণ রণকৌশল, ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত আর সৃষ্টিশীলতা—দিব্যার ক্যারিশমায় মুগ্ধ দাবা দুনিয়া। হ্যাঁ, এর সঙ্গে আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ কথা দিব্যার মুখে শোনা গিয়েছে। “মহেন্দ্র সিং ধোনিকে দেখে শিখেছি, মাথা কীভাবে ঠাণ্ডা রাখতে হয়!” দিব্যার ঠাণ্ডা মাথাই ওকে হয়ত আরও অনেকদুর নিয়ে যাবে।