চরম পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিকূলতার মধ্যেও ছাত্র-ছাত্রীদের পদকগুলোই কুণালের চালিকাশক্তি!

সুদীপ পাকড়াশীঃ ক্যারাটে তার বাঁচার ঢাল। জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক পদকগুলো তার নিঃশব্দ প্রতিবাদ। আর ছাত্র-ছাত্রীদের পদকগুলো তার স্বপ্নপূরণের লড়াই। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। খেলাধুলোর শিক্ষক। কিন্তু তার স্বপ্নকে লালন করার কোনও সঙ্গী পাননি তিনি। নির্মম এক সত্যি যেখানে সন্তান তার স্বপ্ন, ইচ্ছেকে বাস্তবায়িত করার লড়াইয়ে বাবা-মা-কেও পেলেন না! পথভোলা পথিক হয়ে ঘর থেকে কুণালকে বেরিয়ে পড়তে হল তার বাবা আর মায়ের নিয়মিত, অবিরাম মানসিক অত্যাচারে! ছ’বছর হয়ে গেল কুণাল ঘর ছেড়েছেন। মাধ্যমিক পাস করার পর স্কুল ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। “টাকা রোজগারের প্রচণ্ড মানসিক চাপ। যেভাবেই হোক না কেন! এই মানসিক যন্ত্রণা যা পরবর্তীতে শারীরিক অত্যাচারে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল তাতে আত্মহত্যা করার কথা ভাবতে হত যদি না ঘর ছাড়তাম,” কুণাল বললেন। সমাজ কি এই জীবনগুলোকে অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে দেখে যাদের ঘর থেকেও নেই? খাতায় কলমে যাদের সবাই থেকেও আসলে কেউ নেই? ২৫ বছর বয়সী কুণাল বলছেন, “ক্যারাটে দেখেছিল। বারুইপুরে আমার রবিউল হক স্যার দেখেছিলেন। ক্যারাটে আমাকে ধ্বংসস্তুপ থেকে বাঁচার শক্তি জুগিয়েছিল। আমি বাংলার হয়ে কেরল ন্যাশানালে সোনা জিতেছি। কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে সোনা জিতেছি। এছাড়াও খেলোয়াড় জীবনে জিতেছি অজস্র পদক। জাপানের ‘ব্ল্যাকবেল্ট সেকেন্ড-ডানের’ মত আন্তর্জাতিক ডিগ্রি আমার ঝুলিতে এসেছে। ক্যারাটে আমাকে ভেসে যাওয়া জীবনের স্রোত থেকে আবার ফিরিয়ে এনেছে আর পদকগুলো আমাকে ধ্বংসস্তুপে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া সেই মানুষদের বিরুদ্ধে নিঃশব্দ প্রতিবাদ।” অবশ্য ডিগ্রি আর এতগুলো পদকপ্রাপ্তিতেও কুণালের ভাগ্যে শিকে হেঁড়েনি। খড়দহ পুরসভায় ‘অতি স্বল্প’ বেতনের একটা অস্থায়ী চাকরি। ঘরভাড়া এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় খরচ করার পর তাকে দিনের পর দিন নিদ্রাহীন রাত কাটাতে হয়। যে কারণে ফিজিওথেরাপি, ম্যাসিওরের কাজ শিখেছেন রোজগারটা বাড়ানোর জন্য। জাতীয় দলের হয়ে পর্তুগালে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে নামার সুযোগ পেয়েছিলেন শিতো-রিও স্টাইলের এই খেলোয়াড় এবং কোচ। কিন্তু প্রকট আর্থিক প্রতিকূলতায় সঙ্গে সঙ্গে পর্তুগাল যাওয়ায় প্রত্যাখ্যান করেছেন। এখন তার স্বপ্ন মূলত দুটো। এশিয়ান ক্যারাটে ফেডারেশনের সার্টিফিকেট পাওয়া বিচারক হওয়া। আর শিক্ষক হিসেবে নিজেকে আরও ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত করা। তা শৈশবের একটা স্বপ্নকে বাস্তবের ছবিতে রুপান্তরিত করা। ২০ জন ছাত্র-ছাত্রীকে নিয়ে চলছে তার ক্যাম্প। সেখান থেকে দিশান ঘোষের মত ছাত্ররা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও পদক জিতছে। আর ছোট ছোট সাফল্যগুলো কুনালের ইচ্ছেশক্তি আরও বাড়িয়ে দিছে! মাথায় আসছে না প্রত্যেকদিনের ওই ছবিগুলো যে ভোর ৫টা-য় উঠে যেতে হবে পুরসভায় চাকরিটা করতে। সেখানে সহকর্মীরা বলবেন, “তুমি কী এমন স্পোর্টসম্যান যে তোমার চাকরিটা পাকা হবে! তুমি প্রোমোশন পাবে!”