বাবা-মায়ের বলা কথাই অর্ণবের মানসিক শক্তি; লালকমল স্যরকে সাহিলের প্রতিশ্রুতি মাথা ‘গরম’ না করার

সুদীপ পাকড়াশীঃ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিওটা ভাইরাল হয়েছিল। ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে নৈহাটি স্টেডিয়াম থেকে আবার ‘কাছা’ পরে তিনি বাড়ি ফিরছেন। তার আগের দিনই মা-কে দাহ করতে হয়েছে। কিন্তু কে জানে, বাড়ি ফেরার পর মামণি পাঠচক্রের গোলকিপার সেই অর্ণব দাসের আনন্দাশ্রু দেখেছিলেন বাবা আর মা-ই! দুজনের ছবির সঙ্গেই অর্ণব কথা বলেছিলেন! তাদের কাছেই অর্ণবের সমপর্ণ, বলেছিলেন, “তোমাদের কথা রেখেছি।” দু-এক মিনিটের কথা নয়, বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাটা, দুজনের ছবির সঙ্গে কথা বলাটা এবার অর্ণবের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে। ২০২১-এ বাবা প্রয়াত হয়েছেন। তার কয়েক মাসের মধ্যে সংসারের হাল ধরতে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করতে হয়েছিল। দৈনন্দিন জীবনটা তখন ভেঙে যাচ্ছে! সারাদিনের কায়িক পরিশ্রম আর ফুটবল থেকে সরে থাকার মানসিক যন্ত্রণা। অর্ণব কুর্ণিশ করেন ইউনাইটেড স্পোর্টস আর নবাব ভট্টাচার্যকে। ওরা পাশে না থাকলে ফুটবল খেলাটাই হত কি না কে জানে! কয়েকটা মাস চাকরিটা করার পর আবার ফুটবলে ফেরা। ক্লাব এবং ইউনাইটেড স্পোর্টসের সর্বময় কর্তা নবাব ভট্টাচার্যের সহায়তায় ফুটবল খেলেই রোজগার-এটা অর্ণবের কাছে বড় প্রাপ্তি, আনন্দের। তখনও ভুলতেন না দিনে একটি বার বাবা-র ছবির সামনে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে। এখন মা-ও যুক্ত হলেন সেই কথোপকথনে। “বাবা ফুটবল খেলতেন, ভালবাসতেন, তাই আমাকে কখনও উৎসাহ দিতে কাপর্ণ্য করেননি। মা-ও একইরকমভাবে উৎসাহ দিতেন। কিন্তু দুজনেই মাঝে মাঝেই একটা কথা বলতেন যে, জীবন থেমে থাকে না। আমাদের যদি কোনওদিন কিছু হয়েও যায়, তুই থেমে যাস না। সময়ের নিয়মে পরের দিন কিন্তু সুর্য উঠবে। তাই তখন অতীতকে আঁকড়ে ধরে থাকিস না।” তবু চোখ জলে ভিজে আসে। জীবনে প্রথমবার জাতীয় দলের শিবিরে ডাক পাওয়ার খবরে আরও মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু তারপরও প্রবল বাস্তববাদী অর্ণব বলেন, “বাবা-মা-র এই কথাগুলোই আমার মোটিভেশন। প্রত্যেকদিন ওঁদের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ওঁদের সঙ্গে কথা বলাই আমার আগামি দিনের মানসিক শক্তি।” তাই হয়ত অনূর্ধ্ব-২৩ জাতীয় দলের শিবিরে ডাক পাওয়ার খবরেও অর্ণবের কথায় উচ্ছ্বাস বিশেষ নেই। বরং ক্লাবের গোলকিপার কোচ অভিজিত দাসের কাছে নিবিড় অনুশীলনে নিজেকে আরও উন্নত করার দিকেই লক্ষ্য তার। “জাতীয় শিবিরে একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী গোলকিপার থাকবে। সেই কম্পিটিশন জিতে প্রথম একাদশে ঢোকাই এখন আমার লক্ষ্য,” অর্ণব বলছেন। আর সেই লক্ষ্যপূরণের লড়াইয়ে অর্ণবের সঙ্গী মামণি পাঠচক্র, তার শিমুরালির ক্লাবের ভাস্কর জেঠু, পার্থ জেঠুরা, বন্ধুরা, তার গোলকিপার কোচের অবিরাম অনুপ্রেরণা। গত দুই মরশুম মামণি পাঠচক্রের হয়ে কলকাতা লিগে খেলা অর্ণব ইতিমধ্যেই ইউনাইটেড স্পোর্টসের হয়ে দ্বিতীয় ডিভিশন আই লিগ, আইএফএ শিল্ড, অনূর্ধ্ব-১৮ আই লিগ খেলে ফেলেছে। জাতীয় শিবিরে নজরকাড়া পারফরম্যান্স করার জন্য সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে চান অর্ণব। নিজের খেলার ভিডিও দেখেন ভুল ত্রুটি শুধরানোর জন্য। কী আশ্চর্য! অর্ণবেরই সতীর্থ, ইউনাইটেড স্পোর্টসের নতুন তারা, সাহিল হরিজনের সঙ্গে অর্ণবের এখানে কত মিল! সাহিলও ডাক পেয়েছেন অনূর্ধ্ব-২৩ জাতীয় দলের শিবিরে। জানেন যে তাকে নিয়ে বাংলার ফুটবলে হইচইও হচ্ছে। কিন্তু সাহিলের সঙ্গে কথা বলুন। প্রথমেই বলবেন, “চোটের জন্য যে প্রায় এক বছর মাঠ্র বাইরে ছিলাম তখন কেউ মনে রাখেনি। তাই এই হইচই নিয়ে আমার বিশেষ ভাবনা নেই। শুধু পারফরম্যান্স করে যাও। না করতে পারলে তোমাকে কেউ মনে রাখবে না!” অর্ণবের সঙ্গে আরও মিল যে সাহিলও নিজের খেলার ভিডিও দেখেন। অর্ণব দেখেন নিজের ভুল শুধরোনোর জন্য। সাহিলও দেখেন নিজেকে আরও ধারাল কীভাবে করা যায় তার জন্য, আর মোটিভেশন বাড়ানোর জন্য। এই মরশুমে চলতি কলকাতা প্রিমিয়ার লিগে এখনও পর্যন্ত চার ম্যাচে চার গোল করে ফেলেছেন। কিন্তু মাথা গরম করে একটি ম্যাচে হলুদ কার্ডো দেখেছেন। কোচ, অভিভাবক লালকমল ভৌমিক অসন্তুষ্ট। সাহিল বললেন, “লালকমল স্যরকে কথা দিয়েছি আর কোনওদিন কোনও ম্যাচে মাথা গরম করব না।”