বুন্দেলখন্ডের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম ঘৌয়াড়া। গোটা গ্রামে কোন পাকা বাড়ি নেই। সেই গ্রামের পুলিশ কনস্টেবল মুন্না সিং। মুন্না ভোটের ডিউটি করতে গিয়ে কর্তব্যের গাফিলতির অভিযোগে চাকরি হারালেন। ছয় সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে সরকারি আবাসন ছাড়তে হল। তখন সবচেয়ে ছোট মেয়েটির বয়স নয়। সংসারের হাল ধরতে স্কুল ছাড়লেন মুন্নার বড় ছেলে।
ছয় বছরের ছোটটি মিড-ডে মিলের জন্য স্কুলে যায়। মিড ডে মিল মেলে ক্লাস এইট অবধি। খিদে পেলে তখন কি আর পড়ার কথা মনে আসে? অগত্যা মেয়েটি পালায় স্কুল থেকে। প্রায় প্রত্যকেদিনের ঘটনা। কিন্তু স্কুল পালানো মেয়ে কী করত? সারাদিন ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলে বেড়াত! বাঁশের তৈরি ব্যাট। আর টেনিস বল। বাঁশ কেটে তৈরি সেই ব্যাট স্বাভাবিকভাবেই প্রচণ্ড ভারি। তাতেও দমানো যায়নি মেয়েকে! সে তখন থেকেই বল করতে ভালবাসত।
একদিন গ্রামের মাঠে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলছে।দলে একজন জোরে বোলারের অভাব। ডাক পড়লো মেয়েটার। মেয়েটা বল হাতে জিতিয়ে দিল গ্রামকে। শুধু জেতালোই না। একেবারে প্লেয়ার অব দ্যা ম্যাচ। সেই মেয়েই রবিবারের রাতে নভি মুম্বইয়ে ইতিহাস গড়া বিশ্বজয়ী ভারতীয় মহিলা দলের অন্যতম সদস্যা। নাম ক্রান্তি গৌড়। হাত থেকে রক্ত ঝরলেও ঝাঁপিয়ে পড়ে ফিল্ডিং করতে তার এতটুকু দ্বিধা হয় না। এতটাই সাহস আর মনের জোর তার!
কিন্তু ছোট্ট ক্রান্তি থেকে ক্রান্তি গৌড় হয়ে ওঠার নেপথ্যের নায়ক? তার বাবা মুন্না সিং। জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া মুন্না স্বপ্ন দেখতে ভোলেননি। ছোট্ট ক্রান্তির হাত ধরে, স্ত্রী-র গহনা আর কিছু সঞ্চিত পুঁজি নিয়ে মুন্না এলেন ছাতারপুর শহর। মধ্যপ্রদেশ ক্রিকেট সংস্থা তখন উঠতি প্রতিভার সন্ধান করছে। মুন্না ক্রান্তিকে নিয়ে সোজা হাজির হলেন সাই-তে। রাজীব বিলথারে তখন জেলা ক্রিকেট সংস্থার সচিব। ট্রায়ালে ক্রান্তির বোলিং দেখে রাজীব দেরি করেননি। পরেরদিন থেকেই ক্রান্তিকে ট্রেনিংয়ে আসতে বললেন। কিন্তু কিছুদিন ট্রেনিংয়ে আসার পর ক্রান্তি বন্ধ করে দিল সাই-য়ে যাওয়া। কারন সেই খরচ। জামা, জুতো, ব্যাটের খরচ। সে তো কম নয়। কিন্তু রাজীব তাতেও নাছোড়বান্দা। ক্রান্তিকে জুতো কেনার ১৬০০ টাকা দিলেন। জামা দিলেন। আর দিলেন নিজের বাড়িতে আশ্রয়। ছাতারপুরে থেকে গেল কান্তি। শুরু হল ক্রিকেটের প্রথম পাঠ।
কেটে গেলো তিনটে বছর। মধ্যপ্রদেশ ক্রিকেট সংস্থার কোচ হয়ে এসেছেন চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত। পন্ডিত ইন্দোরে একটা ওপেন ট্রায়াল ক্যাম্প আয়োজন করলেন। রাজীব ক্রান্তিকে ইন্দোর পাঠালেন ট্রায়ালের জন্য। ক্রান্তির ছন্দময় সাবলীল বোলিং তাঁকে মুগ্ধ করল। ক্রান্তি চন্দ্রকান্তের নজরবন্দী হলো। ভারতীয় ক্রিকেট মহলে চন্দ্রকান্ত পন্ডিতের কড়া কোচিং পদ্ধতি নিয়ে সকলে অবগত। ক্রান্তির বয়স তখন ১৭। শরীর বদলাচ্ছে। অতিরিক্ত পরিশ্রমে পিঠের ব্যথায় বোলিং করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে। আবার বাড়ি পালানোর কথা ভাবছে ক্রান্তি। সংসারে অভাবের তাড়না পিছু ছাড়েনি। অনেক ক্রিকেট হয়েছে। এবার কিছু রোজগার করতে হবে। খেপ খেলে সহজে পয়সা মেলে। ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের কদর আর প্রচার দেখে অভিমানও হত তার। ক্রিকেট তো ব্যাটসম্যানের খেলা। বোলাররা মজদুর শ্রেণী!

ক্রান্তির মতিগতি বুঝে এমপিসিএ-র মহিলা শাখার জয়েন্ট সেক্রেটারি সিধিয়ানী পাটনি চন্দ্রকান্তের সাথে কথা বললেন। মাসিক রেশন পাঠানোর ব্যবস্থা হল ক্রান্তির বাড়িতে। চন্দ্রকান্তের অনুশাসনে লাইন, লেন্থ ও রিস্ট পজিশন সংশোধনে মন দিলো।
ডব্লিউপিএল শুরু হলো। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে নেট বোলার হিসেবে যোগ দিলো ক্রান্তি। তবে প্রথম প্রচারের আলোয় এলো ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেই। ২০২৪-এ বাংলার বিরুদ্ধে অজ্ঞাতনামা ক্রান্তির নজড়কাড়া বোলিং। আর পিছন ফিরে তাকতে হয়নি। এবছর ইউপি ওয়ারিয়ার্স নিলামে কিনে নেয় ক্রান্তিকে। সেখান থেকে জাতীয় দল। শুরু হয় ভারতীয় ক্রিকেটের ক্রান্তিকাল!






