সুদীপ পাকড়াশীঃ
শান্তনু চ্যাটার্জি। কলকাতা পুলিশের ডিসি সেন্ট্রাল। আর স্বরূপ গোস্বামী। রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের পার্সোনাল সিকিউরিটি অফিসার। দুজনেরই কর্মব্যস্ততা নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজন হয় না।
তবু এই দুই পুলিশ কর্তাই ব্যতিক্রমী হয়ে উঠলেন। চুড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যেও দুজনেই ছুটে চলেছেন আর এক লক্ষ্যে। তাদের ক্যালকাটা পুলিশ ক্লাবকে খেলার জগতে আরও সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে।
শান্তনু চ্যাটার্জি ক্যালকাটা পুলিশ ক্লাবের সচিব। গত ১২ বছর ফুটবল দলের দায়িত্বে। আর স্বরূপ গোস্বামী তৈরি করেছেন ছেলে এবং মেয়েদের রাগবি দল। দেশে পুলিশ এবং সেনাবাহিনী মিলে যতগুলো প্রতিরক্ষা দফতর আছে তার মধ্যে মেয়েদের একমাত্র রাগবি দল তৈরি করেছে ক্যালকাটা পুলিশ ক্লাব। এই ২০২৫-এ-ই। এবং তৈরি হওয়ার মাস চারেকের মধ্যেই মেয়েদের রাগবি দল কলকাতার তিনটে গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্টের দুটোয় রানার্স হয়ে রূপো আর একটিতে ব্রোঞ্জ! আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে। পদকজয়ের তিনটে টুর্নামেন্টের মধ্যেই কলকাতার অন্যতম সেরা ও প্রাচীন দল সিসি অ্যান্ড এফসি-কে হারানো!
আর মেয়েদের দল মানে কারা তারা? ২৫ জন মেয়েদের মধ্যে দুই বা তিনজন অভিজ্ঞ। বাকিদের সবাই নতুন, আনকোরা! কেউ ছিলেন ফুটবলের মূলস্রোতে। কেউ খেলছিলেন ক্রিকেট। কেউ স্বপ্ন দেখছিলেন অ্যাথলিট হওয়ার। তাদেরকে লালন করেছেন স্বরূপ গোস্বামী। নিজে ছিলেন প্রাক্তন জাতীয় রাগবি খেলোয়াড়। ১২ বছর মুলস্রোতে খেলেছেন। তার অধিনায়কত্বে ভারত দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়নও হয়েছে পাকিস্তানকে হারিয়ে। পুলিশের চাকরি তাকে সাময়িকভাবে রাগবি থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু প্যাশনকে কিভাবে সরাবে? তাই সৃষ্টি সুখের উল্লাসে স্বরূপ গোস্বামী ওই আনকোরা মেয়েদের তৈরি করেছেন রাগবি খেলোয়াড়ে। শুধু রাগবি খেলোয়াড় বানানো নয়, অধিকাংশ মেয়েরা এখন কলকাতা পুলিশে চাকরিও পেয়েছেন।
কলকাতার রাগবিতে চমকে দেওয়ার পর স্বরূপ গোস্বামীর তৈরি করা মহিলা দল আর ছেলেরা এবার চলেছে মুম্বই। ৩১ অক্টোবর আর ১ নভেম্বর মুম্বই জিমখানায় হচ্ছে টেন-এ-সাইডের একটি আন্তর্জাতিক রাগবি টুর্নামেন্ট। সেখানে প্রথমবার ক্যালকাটা পুলিশ ক্লাবের মেয়েরা অংশ নেবে। এ-ও তো কম বড় প্রাপ্তি নয়।
এখন স্বরূপ গোস্বামীর স্বপ্ন তার ছেলেমেয়েরা বাংলা এবং জাতীয় দলে সুযোগ পান। গতবছর মুম্বইতে রাগবির ফ্র্যাঞ্চাইজি প্রিমিয়ার লিগ হয়েছে। সেখানে কলকাতার ফিউচার হোপ ফাউন্ডেশনের মেয়েরা নিলামে ডাক পেয়েছেন। স্বরূপ গোস্বামীর লক্ষ্য তার মেয়েরাও ডাক পাক নিলামে। “যতটা আশা করেছিলাম ওদের কাছ থেকে তার থেকে অনেক বেশি দিয়েছে মেয়েরা। মাত্র কয়েকটা মাসের ট্রেনিংয়ে ওরা ৩টে টুর্নামেন্টে যা পারফরম্যান্স করেছে সেটা ভাবিনি। এখন আমার লক্ষ্য ওরা রাজ্য ও জাতীয় দলে ডাক পাক। রাগবি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলুক। আর এর জন্য শুধু আমি নয়, আমাদের কোচ অমিতাভ রক্ষিতেরও প্রচুর অবদান আছে,” বললেন স্বরূপ গোস্বামী।
অমিতাভ রক্ষিতও একজন প্রাক্তন জাতীয় রাগবি খেলোয়াড়। ২০০২-০৩-এ শ্রীলঙ্কায় এশিয়ান রাগবি চ্যাম্পিয়নশিপে জাতীয় দলের সদস্য ছিলেন। ২০০৫ থেকে কোচিংয়ে এসেছেন। এবছরই তাকে ক্যালকাটা পুলিশ ক্লাব রাগবি দলের কোচের দায়িত্বে এনেছে। ৬২ বছর বয়সী এই কোচ জানালেন, “শান্তনু চ্যাটার্জি আর স্বরূপ গোস্বামীর অক্লান্ত পরিশ্রমেই রাগবি দল প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
জলপাইগুড়ি থেকে অনেকটা ভেতরে, প্রত্যন্ত গ্রাম সরস্বতীপুর থেকে মেয়ে আনা হয়েছে। শ্যাওড়াফুলি থেকে এসেছে মেয়েরা। প্রথমে এদের মধ্যে একটু ভয় হিল। রাগবি তো বডি-কন্টাক্ট খেলা। তারপর ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়েছে। খেলার টেকনিক শিখেছে। হ্যাঁ, এদের পেছনে প্রচুর সময় দিতে হয়েছে। স্বরূপ গোস্বামী আর শান্তনু চ্যাটার্জির উৎসাহ আর উদ্যোগে এরা কিন্তু পুলিশে চাকরিও পেয়েছে। চাকরির সুবাদে বিনামূল্যে গুণগত মানের চিকিৎসার সহায়তা পাচ্ছে এরা। তারপর প্রত্যেকদিন ট্রেনিংয়ের পর উন্নতমানের টিফিন পায় এরা।” বললেন অমিতাভ রক্ষিত।
ক্যালকাটা পুলিশ কলকাতার প্রাচীন ক্লাবগুলোর একটি। ১৯৩২-এ তার পথ চলা শুরু। তার ফুটবল, ক্রিকেট, হকি দলের ধারাবাহিকভাবে সংশ্লিষ্ট লিগগুলোতে খেলার ইতিহাস নতুন নয়। সিএবি পরিচালিত বাংলার ক্রিকেট লিগে এবং কলকাতার প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে ক্যালকাটা পুলিশ ক্লাবের পরিচিতি নজরকাড়া। ক্রিকেটে দল ওপরের দিকে খেললেও, সদ্যসমাপ্ত কলকাতা প্রিমিয়ার লিগে ক্যালকাটা পুলিশের পারফরম্যান্স আশাপ্রদ নয়। শেষম্যাচে ইস্টার্ন রেলের সঙ্গে ড্র, একইসঙ্গে লিগ থেকে সাদার্ণ সমিতির নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার ফলে, ক্যালকাটা পুলিশ ক্লাব কোনওরকমে অবনমন বাঁচিয়েছে। গতমরশুমে ফুটবল দলের ছবিটা অবশ্য অনেকটা ভাল ছিল। ক্যালকাটা পুলিশ একটুর জন্য সুপার-সিক্সে উঠতে পারেনি। লিগ টেবিলে সাতে শেষ করেছিল।
কিন্তু এই মরশুমের ফলাফলে খুব একটা বিচলিত নন, ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শান্তনু চ্যাটার্জি যিনি ২০১১৩ থেকে ফুটবল দলের দায়িত্বে রয়েছেন। আগামি মরশুমের দিকে তাকিয়ে তার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রবল ব্যস্ততার মধ্যেও। কাজে আপাতত প্রথম উদ্যোগ নিজেদের একটা মাঠ জোগাড় করা। মেট্রো রেলের কাজ চলায় কালিঘাট এবং ক্যালকাটা পুলিশের মাঠ এখন রেলের দখলে।
শান্তনুবাবুর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ফুটবল দলের জন্য বাজেট বাড়ানোর চেষ্টা করা। বললেন, “আমি ক্লাবের সচিব হতেপারি। কিন্তু টাকা জোগাড়ে আমাদের কমিটির প্রত্যেক অফিসারের অবদান সমান। আমরা প্রত্যেকে ব্যস্ততার ফাঁকে সময় বার করে নিজেদের প্যাশনকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করি। গত মরশুমে দলগঠন দেরিতে শুরু হয়েছিল। এবার আগে শুরু করব যাতে আগামি মরশুমের কলকাতা প্রিমিয়ার লিগে সুপার-সিক্সে খেলতে পারি।”