সুদীপ পাকড়াশী
কোনওদিন ভোলা যাবে না ওই সাতটা যন্ত্রণাবিদ্ধ মাস! যার শুরু গতবছর দ্বিতীয় ডিভিশন আই লিগে গোয়ায় ইউনাইটেড স্পোর্টসের শেষ ম্যাচ। সেই ম্যাচেই গোড়ালির গুরুতর চোট। কলকাতায় ফিরে অস্ত্রোপচার এবং ফুটবল মাঠ থেকে সাত মাঠের নির্বাসন।
আইএসএল, আইপিএল, ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানে মজে থাকা বাংলার মিডিয়া জানতে চায়নি চোট পেয়ে নির্বাসনে যাওয়ার আগে ১৯ বছরের ছেলেটি ওই দ্বিতীয় ডিভিশন আই লিগেই ৭টি গোল করে ফেলেছিলেন।
ভাগ্যিস তার আগের বছর, ২০২৩-এর কলকাতা প্রিমিয়ার লিগে দুর্গাপুরে সার্দাণ সমিতির বিরুদ্ধে বাইসাইকেলে করা দুর্দান্ত গোলটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল! সাংবাদিকদের একাংশ ছুটেছিলেন শ্যাম থাপার প্রতিক্রিয়া জানতে। ভিডিওটি দেখে কিংবদন্তি সেই স্ট্রাইকারের ছোট্ট প্রতিক্রিয়া ছিল, “ছেলেটির সময়জ্ঞান বেশ ভাল।”
২৮ জুন, শনিবার রবীন্দ্র সরোবরের কাদায় প্রচণ্ড ভারি হয়ে যাওয়া মাঠে আবার কলকাতা প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ। প্রতিপক্ষ এরিয়ান। বল ধরে অসাধারণ হাফ-টার্নে চারজনকে অনায়াস ঔদ্ধত্যে প্রতিপক্ষের চারজনকে টপকে ১৮ গজের বক্সের বাইরে থেকে বাঁ পায়ের একটা কার্লিং শটে গোল করার পর সেই সাহিল হরিজন ভাবছিলেন সাতটা মাসও তো একটা সময়!
“কেউ মনে রাখে না। ২০২৩-এ যে আমার প্রথম কলকাতা প্রিমিয়ার লিগে ১৪টা গোল ছিল, সেই বছরই দ্বিতীয় ডিভিশন আই লিগে যে ১১টা গোল করেছিলাম, এমনকী গতবছর চোট পাওয়ার আগেও ইউনাইটেড স্পোর্টসের হয়ে যে গতবছরের দ্বিতীয় ডিভিশন আই লিগে ৭টা গোল করেছিলাম, কে মনে রেখেছে?” সাহিলের প্রশ্ন।
বাবা-মা আর তার নবাব কাকু, ইউনাইটেড স্পোর্টসের ডিরেক্টর-এই তিনজনের কথা সাহিলের বার বার মনে পড়ছে আজ। “নবাব কাকু অনেকবার বাড়িতে এসেছেন দেখতে। শুধু বলতেন মনের জোরটা ধরে রাখতে। ঠিক পারবি,” রবিবার কথা বলার সময় সাহিলের গলায় ক্লাবকর্তার প্রতি অপার কৃতজ্ঞতা।
আর বাবা-মা? সাহিল বলছে, “একদিনের জন্য হতাশা প্রকাশ করেননি। সবসময় বলে গিয়েছেন মনকে শক্ত করতে। মনই ফেরার লড়াই শুরু করে।” ওদের কথা রেখেছেন সাহিল। গোড়ালিতে প্লাস্টার বাঁধা। বিছানায় বসে বসেই শরীরের ওপর অংশের কসরৎ চালিয়ে যাওয়া। টিভিতে নিজের পুরোনো ম্যাচ দেখে, আদর্শ ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ম্যাচ দেখে, সুস্থ থাকার জন্য তার ফিজিক্যাল ট্রেনিংয়ের ভিডিও দেখে মানসিকভাবে চাঙ্গা থাকার চেষ্টা করা। তারপরও তো মন মানতে চায় না। কলকাতা লিগের ম্যাচ চলছে। বন্ধু ফুটবলাররা খেলছে আর আমি বাড়িতে প্লাস্টার বেঁধে বসে আছি! চোখে জল এসে যায়। কত রাত কেটেছে, ঘুম আসেনি। “খেলোয়াড় জীবন শুরু হওয়ার পর কোনওদিন হয়নি যে আমি ফুটবল ছুঁইনি। প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত জেগে ভাবতাম কবে রিহ্যাব শুরু হবে, কবে আবার বলটাকে স্পর্শ করব,” সাহিলের স্মৃতিচারণ।
কী শেখালো ওই যন্ত্রণার সাতটা মাস? “মানসিকভাবে আরও শক্তিশালী হয়েছি। বুঝেছি মূলস্রোতে থেকে পারফর্ম করতে না পারলে তোমাকে কেউ মনে রাখবে না।” শনিবার রবীন্দ্র সরোবরে ম্যাচের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় বোঝা যায়নি সাহিলের ভেতরটা আরও কত শক্তিশালী হয়েছে!
এই উপলব্ধি আরও গাঢ় হল খুব সম্প্রতি কলকাতার এআইএফএফের সেন্টার অফ এক্সেলেন্সে সিনিয়র জাতীয় দলের বিরুদ্ধে একটা প্রীতি ম্যাচের দিন। “খুব খারাপ খেলিনি। ম্যাচের পর সুনীল ছেত্রীর অভিনন্দনে সেটা বুঝেছি। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বাক্য আমাকে বলেছিল যে, নিজেকে চেনাতে হলে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে।”
ভারতের জার্সি পরা সুনীলের সঙ্গে ছবিটা বাঁধিয়ে বাড়িতে রেখে দিয়েছেন সাহিল। ছবিটা দেখেন শুধু দেখার জন্য নয়। নিঃশব্দে তৈরি করছেন একটা লক্ষ্য। “ভারতের জার্সি পরা সাহিল হরিজনের সঙ্গেও একদিন কোনও ‘প্রমিসিং ফুটবলার’ এভাবেই ছবি তুলবে,” সাহিলের লক্ষ্য! আর এই লক্ষ্যে সাহিলের নিজের পরিশ্রমের সঙ্গে অন্যতম সঙ্গী তার বর্তমান কোচ লালকমল ভৌমিক। “কোচ নন, বন্ধু, অভিভাবক। নিজেও তো সৃষ্টিশীল ফুটবলার ছিলেন। তাই যে কোনও সৃষ্টিশীল ফুটবলারকে প্রচণ্ড সাপোর্ট করেন,” সাহিলের গলায় আত্মবিশ্বাস।