চার মাস পরিশ্রমের পুরস্কার এই সেঞ্চুরি: বৈভব

হয়তো তিনি ঘোরের মধ্যে ছিলেন। কী হচ্ছে কিছুই যেন বুঝতে পারছিলেন না। সকলের প্রশংসা মুখের চওড়া হাসিতে উত্তর দিচ্ছিলেন। এরই মাঝে পুরস্কার মঞ্চ থেকে ডাক পড়ল। ম্যাচের সেরা বৈভব সূর্যবংশী। এটা জানাই ছিল। তই অবাক হতে দেখা গেল না। তিনি এগিয়ে গেলেন। তারপর যা বললেন, তা বৈভবরে মুখ থেকে শুনে নেওয়া যেতে পারে। সত্যি বলছি,এখন বিশ্বাস করতে পারছি না। এটা দারুন এক অনুভূতি। আইপিএলে তিন নম্বর ম্যাচে আমার প্রথম সেঞ্চুরি। এ নিয়ে কথা বলতে গেলে অনেক কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে। অকশন থেকে রাজস্থান রয়্যালেস আসার পর টানা পরিশ্রম করে গিয়েছি। বলতে সেই প্র্যাকটিসের এটাই পুরস্কার। মাঠে ভর্তি লোক। স্টেডিয়ামে কোথাও পাঁকা ছিল না। তবে আমি ভাল করে দেখিনি। কারন মাঠে নেমে আমি কখনও গ্যলারির দিকে তাকাই না। আমার নজর থাকে বোলারের হাতের দিকে। বল ছাড়ার সময় তাদের হাতের পজিসন দেখি। এবং বুঝে যাই কোন বল কোথায় আসবে। সেদিকে ফোকাস থাকে বলে কোথায় কি হচ্ছে ত বুঝতে পারি না। যশ্বসীর সঙ্গে ব্যাট করতে ভাল লাগে। ওর সঙ্গে কথা বলে নিজের আত্মবিশ্বাস পাই। আসলে ও নিজে খুব পজিটিভ। কখন নেগেটিভ জিনিস মাতায় কাজ ককরতে দেয় ন। সবাইক সেই কথাই বলে। আমার তাই সুবিধা হয়। কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। সেঞ্চুরি পেলে সকলের ভাল লাগে। আমারও লাগছে। আইপিএলে সেঞ্চুরি পেলাম। বলতে পারেন স্বপ্ন বাস্তবে নেমে এল। আমার বিপক্ষে কোন বোলার ব করছে সেদিক তাকাই না। আমি কাউকে ভয় পাই না। জানি, আমাকে খেলতে হবে। রান করতে হবে। সেখানে ভয় বলে কিছু থাকলে সফল হওয়া যাবে না। তাই মনে কোনও সংশয় নিয়ে ব্যাট করি না।
বৈভব কীর্তি! বস বেবির ঘোরে আচ্ছন্ন ভারতীয় ক্রিকেট

১৬ বছরের সচিন তেন্ডুলকরকে টেস্ট খেলতে দেখেছিল গোটা বিশ্ব। দেখেছিল দুরন্ত ওয়াকার ইউনিসকে শাসন করতে। কিন্তু সেই সচিনও বিস্ফোরিত চোখে দেখলেন ১৪ বছরের এক বাচ্চাকে অবিশ্বাস্য কীর্তি গড়তে। বৈভব সূর্যবংশী – বিহারের এই তরুণ, না তরুণ নয়, কিশোর, বিস্ময় কিশোর জয়পুরে এ কী কাণ্ড ঘটালেন! সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসাবে টি টোয়েন্টিতে শতরানের বিশ্বরেকর্ড! আইপিএলে দ্য ইউনিভার্স বসের পরেই এই বস বেবি। হ্যাঁ, জাস্টিন ল্যাঙ্গার নামটা দিয়েছেন। দ্বিতীয় দ্রুততম শতরান। গেইল করেছিলেন ৩০ বলে আর ১৪ বছর ৩২ দিনের বস বেবি করলেন ৩৫ বলে। অবিশ্বাস্য কীর্তি গড়া দেখে বিস্ফোরিত ক্রিকেটবিশ্ব। আইপিএলে দ্রুততম শতরানে যাঁর রেকর্ড ভাঙলেন, সেই ইউসুফ পাঠান থেকে যুবরাজ সিং, হরভজন সিং থেকে কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত – বিস্ময়, আবেগ, উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে চলেছেন বৈভবকে, বৈভবের কীর্তিকে। ১৪ বছর বয়সে তুমি কী করতে? এই প্রশ্নটাই ছুঁড়ে দিয়েছেন বিস্মিত যুবরাজ সিং। যুবির পোস্ট, “এই বাচ্চা ছেলেটা এমনভাবে বিশ্বের সেরা বোলারদের মোকাবিলা করল, চোখের পাতা ফেলতে দিল না। বৈভব সূর্যবংশী – নামটা মনে রাখুন। কী ভয়ডরহীন অ্যাপ্রোচ! পরের প্রজন্মকে উঠে আসতে দেখে গর্ব হচ্ছে।“ কিংবদন্তি সচিন তেন্ডুলকর অবিশ্বাস্য শতরানের ক্রিকটীয় ব্যাখ্যা দিয়েছেন। লিখেছেন, ভয়ডরহীন অ্যাপ্রোচ, ব্যাটের গতি, দ্রুত বলের লেংথ বুঝে নেওয়া এবং বলের পিছনে এনার্জিকে জেনারেট করা – এগুলোই এমন দুরন্ত ইনিংসের রেসিপি। ইউসুফ খান পোস্ট করেছেন, “আমার রেকর্ড ভাঙার জন্য অজস্র অভিনন্দন। ভারতীয় হিসাবে আইপিএলে দ্রুততম শতরান। সত্যিই স্বপ্নের মত।“ শ্রীকান্তের কথায়, ১৪ বছর বয়সে তো বাচ্চারা আইসক্রিম খাওয়ার কথা ভাবে। ভারতীয় ক্রিকেটের পরের মহাতারকা এসে গেল। হরভজন সিং থেকে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পি চিদাম্বরম – সকলেই বিস্মিত, আপ্লুত, বস বেবির ঘোরে আচ্ছন্ন।
৩৮ বলে ১০১, ম্যাকুলাম, গেইলকেও ছাপিয়ে গেলেন সূর্যবংশী

গুজরাট টাইটান্স: ৪ উইকেটে ২০৯ ( ২০ ওভার) রাজস্থান রয়্যালস: ২ উইকেটে ২১২ (১৫.৫ ওভার) এত তাড়াতাড়ি রাতটা আসবে আগে কে ভেবেছিলেন। বৈভব সূর্যবংশীও নন। ইচ্ছে ছিল ভাল কিছু করার। রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে প্রথম দুটি ম্যাচ খেলার পর ভবিষ্যতের তারকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। আরও ভাল খেলার আশা জাগিয়েছিলেন। কিন্তু আইপিএলে নিজের তিন নম্বর ম্যাচে জাতীয় দলের বোলারদের মেরে ৩৮ বলে ১০১ রান করবেন, তা সতীর্থরাও ভাবেননি। কিন্তু জয়পুরের মাঠে সেটাই করে দেখালেন ১৪ বছরের বৈভব। তাঁর ব্যাটিং দাপটে রাজস্থান ৮ উইকেটে হারিয়ে দিল হট ফেভারিট গুজরাট টইটান্সকে। অবাক করার বিষয় এটাই যে ২১০ রানের টার্গেটে ছুটতে গিয়ে ২৫ বল বাকি থাকতে রাজস্থান ম্যাচ বের করল। সেট সম্ভব হল বৈভব সূর্যবংশীর দাপুটে ব্যাটিংয়ের জন্যই। ২৬৫.৭৮ স্ট্রাইক রেটে ৭টি বাউন্ডারি ও ১১টি ওভার বাউন্ডারির সাহায্যে ভারতীয়দের মধ্যে তিনি দ্রুততম সেঞ্চুরিয়ান। তাঁর সেঞ্চুরি এল ৩৫ বলে। প্রথমজন ক্রিস গেইল। তিনি ৩০ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন। এই লড়াইয়ে ম্যাকুলামের কথাও উঠে আসে। প্রথম আইপিএলে তিনি নাইটদের হয়ে বিধ্বংসী মেজাজ দেখিয়েছিলেন বেঙ্গালুরুর মাঠে। ৭৩ বল করেছিলেন ১৫৮ রান। পাঁচ বছর পর আরসিবির হয়ে পুনে ওয়ারিয়ার্সের বিরুদ্ধে গেইল করেছিলেন ১৭৫ রান। এঁরালকেউ বৈভবের পাশে দাঁড়াতেে পারছেন না। কারন ওঁরা আইপিএল খেলেছিলেন অনেকটা পরিণত হয়ে। আর বৈভব বলতে গেলে দুধের শিশু। তাঁর সঙ্গে ওদের লড়াই চলে না। এগিয়ে রাখতে হচ্ছে বৈভবকে। সোমবারের রাতটা জয়পুরের মানুষ কোনদিন ভুলতে পারবেন না। যাঁরা মাঠে ছিলেন, তাঁরা উপভোগ করেছেন। পয়সা উশল বলে একটা কথা আছে। সেটাই শেষপর্যন্ত তাঁরা পেয়ে গেলেন। সিরাজ, ইশান্ত, প্রসিদ্ধ, রশিদ, কেউ বাদ গেলেন না। সবাইকে মেরে বুঝিয়ে দিলেন ক্রিকেট বিশ্বকে শাসন করতে তিনি এসে গিয়েছেন। এতদিন খেলেছেন জুনিয়র ক্রিকেটে বোলারদের বিরুদ্ধে। কিন্তু আইপিএলের মঞ্চে কেউ কাউকে ছেড়ে দেওয়ার লোক নন। বাউন্সার, ইয়র্কার দিয়ে ব্যাটসম্যানকে চাপে ফেলার চেষ্টা করেন। কিন্তু বৈভব শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে এতটাই শক্তিশালী যে তাঁকে টলানো গেল না। সঙ্গে টেকনিকেও খামতি ছিল না। পুরো ইনিংসে দুএকটা ভুল যে হয়নি তা নয়। ফিল্ডাররা সজাগ থাকলে অনেক আগে তাঁকে ফিরতে হত। কথায় বলে সাহসীদের ভাগ্য সাথ দেয়। তেমনই সূর্যবংশী। কখনও ভয় পাননি। সাহসে ভর করে বোলারদের ঘাড়ে চেপে রানের পিছনে ছুটেছেন। ১১টি ওভার বাউন্ডারির মধ্যে বেশিরভাগ স্ট্রোক এসেছে অনের দিকে খেলে। মিড উইকেট থেকে স্কোয়ার লেগ, এই অঞ্চল দিয়ে বল মাঠের বাইরে ফেলেছেন। যশ্বসীর সঙ্গে ব্যাট করতে ভাল লাগে। ১১.৫ ওভারের ইনিংসে যশ্বসী ( ৪০ বলে ৭০ রান) বারবার বলেছেন, উইকেট যেন ছুঁড়ে দিয়ে না আসে। নিজের স্ট্রোক খেলে রান তোলার দিকে ছুটতে বলেছেন। বৈভব সেটাই করেছেন। শেষে প্রসিদ্ধর ইয়র্কারে হার মানেন। প্রথম উইকেটে ১৬৬ রানের পার্টনারশিপ গড়ে বৈভব যখন ফিরছেন, তখন গোটা স্টেডিয়াম উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে। তিন নম্বরে ব্যাট করতে আসছিলেন নীতিশ রানা। তিনিও বুকে জড়িয়ে ধরেন। আর ডাগ আউটে বসা ক্রিকেটারদের কথা কী বলব। সবাই চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছেন। বৈভব কাছে আসতে অনেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। কেউ পিঠ চাপরে দিলেন। যাঁকে ঘিরে এত আনন্দ, এত উত্তেজনা, সেই বৈভবের মুখে চওড়া হাসি। তিনি পেরেছেন। স্বপ্নকে বাস্তবে নামিয়ে এনেছেন। এবার এটা ধরে রাখতে হবে। থেমে গেলে চলে না। কিন্তু সে সব তো পরের কথা। এই রাত কি তাড়াতাড়ি শেষ হয়। স্টেডিয়ামের সার্চলাইট পুরোটাই বৈভবকে ধরে রেখেছে। দলের জয় না আসা পর্যন্ত তিনি ডাগআউটে বসেছিলেন। তারপর মাঠে ঘুরে বেড়ালেন। এই রাত তাঁর একান্ত আপন। যে ছবির জন্য অপেক্ষায় অনেকেই ছিলেন, তাঁকে দেখা গেল না। হ্যাঁ, তিনি রাহুল দ্রাবিড়। এই রাতটা তো তাঁরও। তাঁর কথায় রাজস্থান অকশন থেকে লড়াই করে তুলে এনেছিল। ফল পেতে অপেক্ষা করতে হল না। রাজস্থানের কঠিন সময়ে সঞ্জু স্যামসন চোট পেয়ে বাইরে চলে যেতে সুযোগ এল বৈভবের কাছে। তার পরের কথা সকলের জানা। তাই এই রাতটা বৈভবের সঙ্গে রাহুলেরও। কিন্তু তাঁকে দেখতে পাওয়া গেল না।