রাতটা তার। শুধুই তাঁর। চোখে জল, মুখে হাসি নিয়ে বলে গেলেন, আজ রাতে শিশুর মত ঘুমোবেন। শিশু, সত্যিই এক শৈশবের উচ্ছ্বাস দেখল ক্রিকেট দুনিয়া। দেখবে না? উফঃ আঠারোটা বছর। কম দিন! দাঁতে দাঁত চেপে, চোয়াল চেপে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন এই রাতটার জন্য। হ্যাঁ, বিরাট কোহলিই একমাত্র ক্রিকেটার, যিনি একটি মাত্র ফ্র্যাঞ্চাইজিতেই খেলে গিয়েছেন। খেলে গিয়েছেন আঠারো বছর ধরে। অবশেষে এল মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রথমবার আইপিএল ট্রফি হাতে তুলে ধরলেন বিরাট। স্বস্তি পেল আসমুদ্রহিমাচল। খুশি হল ক্রিকেট দুনিয়া। না, এই ট্রফিটা না পেলেও কিছু হত না। বাইশ গজের সব সাফল্যই ধরা দিয়েছে তাঁর কাছে। সাফল্য তাঁকে কিংবদন্তি বিরাট কোহলি করে দিয়েছে আগেই, তবু, তবু এটুকুই বা বাকি থাকবে কেন? কেরিয়ারের শেষ পর্বে এসে একদিনের বিশ্বকাপ জিতে বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছিল সচিন তেন্ডুলকরের। ঠিক একইভাবে আহমেদাবাদে ৩ জুনের মায়াবী রাতে বৃত্ত সম্পূর্ণ হল কিং কোহলির।
ই সালা কাপ নামদু অর্থাৎ এ বছর কাপ আমাদের। স্লোগানটা বছরের পর বছর দিয়ে এসেছে বেঙ্গালুরু। দিয়ে এসেছেন বিরাট কোহলি। এদিন আরসিবির দুই প্রাক্তন সতীর্থ ক্রিস গেইল ও এবি ডিভিলিয়ার্সকে জড়িয়ে ধরে সমস্বরে স্লোগানটা তুললেন তৃপ্ত কোহলি। “আরসিবিকে আমার যৌবনটা দিয়েছি, আমার সেরা সময়টা দিয়েছি। আমার অভিজ্ঞতাটা দিয়েছি। আরসিবি আমার হৃদয়, আমার আত্মা” – আবেগ, আবেগ তখন বাঁধ মানছে না বিরাটের।
তিন বল বাকি থাকতেই ট্রফিজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। তখনই মুখ ঢাকলেন নায়ক। শেষ বল হতেই দু’হাতে মুখ ঢেকে হাঁটু মুড়ে বসে মাটিতে মুখ গুঁজলেন। আবেগটা যে তখন বড় বাড়াবাড়ি করছিল। চোখের জল কি দেখতে দেওয়া যায়! মাঠের চর্তুদিক থেকে ধেয়ে এলেন সতীর্থরা। তাঁদের বুকে হারিয়ে গেলেন ‘শিশু’ কোহলি। গ্যালারিতে অনুষ্কা আর মাঠের মধ্যে বিরাট – অনুভূতি, অভিব্যক্তি মিলিয়ে দিল দু’জনকে। আর বন্ধুর টানে সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ছুটে আসা প্রাক্তন আরসিবি সতীর্থ ডিভিলিয়ার্স তখন মোবাইলে সেই ছবি ধরে রাখতে ব্যস্ত। দ্য ওয়েট ইজ ওভার – হ্যাঁ, এবির-ও যে!
মাঠে নেমে এসে বন্ধুকে বুকে টেনে নিলেন এবি। ততক্ষণে নেমে এসেছেন অনুষ্কাও। তারপরই রাতের সেরা ছবিটা – দুজনে দুজনকে পরম আবেগে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। দুজনেই হাসছেন। কাঁদছেন। অনুষ্কার কপালে চুম্বন এঁকে দিলেন তিনি – স্বামীর কৃতজ্ঞতা। গলা বুজে আসছিল বিরাটের, বললেন “ওর ত্যাগ, আমার জন্য দায়বদ্ধতা- কী বিরাট অবদান!”
গেইল-এবিরাও তখন আরসিবির জার্সি গায়ে চড়িয়ে নিয়েছেন। দুজনকে জড়িয়ে ধরে কোহলির অভিব্যক্তি, “এ সাফল্য যতটা আমাদের ততটা ওদেরও। ওঁদের উপস্থিতি আনন্দ ১০গুন বেশি স্পেশ্যাল করে তুলেছে।“ একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাপটার জন্য লড়াই করেছেন বছরের পর বছর। এবি নিজেও দুটি ফাইনাল খেলেছেন। তাই কাপ যখন এল, তখন এবি যেমন দূরে থাকতে পারেননি, তেমনি কোহলিও জানিয়ে দিলেন ওঁদের সেলিব্রশনেও থাকবেন এবি। দক্ষিণ আফ্রিকান কিংবদন্তিও কতটা আরসিবির, বুঝিয়ে দিলেন বন্ধু। বাকরুদ্ধ হয়ে সেসব দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে নভজ্যোৎ সিং সিধুও বলে উঠলেন তাঁর প্রিয় পঞ্জাব হেরেছে কিন্ত প্রিয় কোহলি তো জিতেছেন। শুনেই সিধুকেও বুকে নিলেন বিরাট।
গোটা বিশ্বের, গোটা দেশের বিরাটভক্তদের অবস্থা যদি এমন হয়, তাহলে আরসিবি ভক্তদের এ কেমন রাত বুঝবেন না তিনি! বছরের পর বছর ই সালা কাপ নামদু স্লোগান ব্যর্থ হতে হতে ১৮তম বছরে স্বপ্নপূরণ। ফ্যানেদের জন্য খুব সহজ আবেগ কোহলির গলায়, সাফল্য যতটা আমাদের, ততটাই ওঁদেরও।
আবেগ তো তাঁর সহজাত। মাঠে, মাঠের বাইরেও। রান করলেও আবেগ। আউট হলেও অন্যরকম আবেগ। তাহলে আজ তাঁর কী হবে, সেটা তো জানাই ছিল। তবু অনুষ্কা হয়ত তখন ভাবতে শুরু করেছেন, এবার থাম তুমি। যাও সতীর্থদের সঙ্গে উৎসব কর। তারপর তুমি যা চাও বললে, তাই কর, শিশুর মত ঘুমোও। যাও বিরাট। যাও।