বাংলার অ্যাথলেটিক্সে বিজয় মালিয়া হলেন কুন্তল রায়? চমকে উঠছেন নিশ্চয়। ভাবছেন, ব্যাপারটা কি? প্রায় এক দশক আগে কলকাতা ময়দানে দুই প্রধান মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলকে একসঙ্গে স্পনসর করেছিলেন বিজয় মালিয়া। তঁার গ্রুপ ইউবি দুই প্রধানে অর্থ দিয়ে ফুটবল দল চালাতো। ঠিক সেই রকমভাবে দুই প্রধানকে অ্যাথলেটিক্সে বঁাচিয়ে রেখেছেন কুন্তল রায়। তঁার হাতে গড়া এসিসি বা অ্যাথলেটিক্স কোচিং সেন্টার থেকে দুই প্রধানে একগাদা অ্যাথলিট নাম লিখিয়ে ছিলেন। তঁাদের উপস্থিতি রাজ্য অ্যাথলেটিক্সে এবার চ্যাম্পিয়ন করেছে ইস্টবেঙ্গলকে। লাল-হলুদের ঘরে মশাল জ্বালিয়েছে এসিসির অ্যাথলিটরাই। একই ঘটনা মোহনবাগানের ক্ষেত্রেও। রাজ্য অ্যাথলেটিক্সে রানার্স হওয়ার মূলে সেই এসিসি। এরপর কি বলা যাবে না অ্যাথলেটিক্সে ‘বাংলার মুখ’ এখন এসিসি? মনে হয়না ভুল বলা হবে। বিজয় মালিয়া অর্থ দিয়ে দুই প্রধানকে ফুটবলে বঁাচিয়ে ছিলেন। অ্যাথলিট দিয়ে সেই জায়গায় দুই প্রধানের নামকে উজ্জ্বল করেছেন কুন্তল রায়। পার্থক্য শুধু একটাই, বিজয় দিয়েছিলেন অর্থ, কুন্তল রায় দিয়েছেন অ্যাথলিট।
তরুণ বাউরি। ঐশ্বিনিয়া প্রিয়দর্শী। শিখর রাই।
বাংলার অ্যাথলেটিক্সে একমাত্র দ্রোণাচার্য কুন্তল রায়ের কাছে এসিসি হল একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। শুধু কুন্তল রায়? পরিবারটাই যেন বাংলার অ্যাথলেটিক্সকে সঁপে দিয়েছে। কুন্তল রায়ের স্ত্রী শুভ্রজা রায় হলেন একদা বাংলার প্রখ্যাত অ্যাথলিট। তারউপর ছেলে রুদ্র প্রতিম রায়। যিনি এখন ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সের একজন বিখ্যাত কোচ। একসময় ভবানীপুর, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডানের মতো দলের নিয়মিত স্ট্রেংথ এন্ড কন্ডিশনিং কোচ ছিল। পরিবারের তিনজনই এখন বাংলার অ্যাথলেটিক্সে ধারক-বাহক। ইস্টবেঙ্গল রাজ্য মিটে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কারণ তুলে ধরতে গিয়ে কুন্তল রায় লাজুক মুখে বলছিলেন, “আমাদের জন্যই যে ইস্টবেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তা বললে হয়তো একটু বাড়াবাড়ি করা হবে। জুনিয়রে মাত্র দুজনকে দিয়েছিলাম ইস্টবেঙ্গলে। মোহনবাগানকে দিয়েছিলাম ৬জন। সিনিয়র স্তরে মোহনবাগানকে দিই ১০জনকে। ইস্টবেঙ্গলকে দিই ৫জন। এরিয়ানকে ৩জন। ১৬জন নেমেছিল উত্তর ২৪ পরগণার হয়ে। বেহালা ক্লাব, সিটি ক্লাব, হাওড়া জেলা, পাইওনিয়ার ক্লাব ও নদীয়া জেলার হয়ে একজন করে নামে। সব মিলিয়ে এসিসি থেকে এবার রাজ্য মিটে নেমেছিল ৪৮জন। তারমধ্যে আমাদের ঘরে পদক এসেছে ৪২টা। সোনা ১৭, রুপো-১৯ ও ৬টা ব্রোঞ্জ।”
বিদিশা কুন্ডু। দীপ্তি রাজবংশী।
শুধু পদক নয়, জুনিয়র ও সিনিয়র মিলিয়ে ৬টা রেকর্ড গড়েছেন এসিসি-র অ্যাথলিটরা। এই ৬জন হলেন দীপ্তি রাজবংশী (শটপুটে), তরুণ বাউরি (১১০ মিটার হার্ডলস), বিদিশা কুন্ডু (হেপ্টাথেলন), মেঘাদ্রি সাহা (হেপ্টাথেলন), শিখর রাই (ডেকাথেলন), ঐশ্বরিয়া প্রিয়দর্শী (ট্রায়োথেলন)। এঁদের মধ্যে সিনিয়র হলেন বিদিশা কুন্ডু, শিখর রাই, তরুণ বাউরি। হীরক সেন দ্বিতীয় হলেও ডিসকাস থ্রোতে গতবারের রেকর্ড ভেঙেছেন। একাধিকজন রেকর্ড গড়লেও জহুরীর চোখ কুন্তল রায়ের কাছে তিনজন হলেন আগামী দিনের স্বপ্নের দিশারি। “আমি তিনজনকে এগিয়ে রাখব। বিদিশা কুন্ডু, তরুণ বাউরি ও সায়ন বিশ্বাস। শুভম পালের কথাও বলব। ছেলেটা যদি একটু নিজেকে নিয়ে ভাবে তাহলে অনেক দূর যাবে। এদেরকে নিয়ে আগামী দিনে অনেক স্বপ্ন দেখা যায়। সিন্থেটিক টার্ফ এসিসিতে রয়েছে। যদিও সেই টার্ফ কিছুদিনের মধ্যে অনেকটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেইসময় কুলীন পাড়া মাঠ যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিত তাহলে আমরা সমস্যায় পড়ে যেতাম। তাই রাজ্য মিটে এসিসি যা কোনওদিন পায়নি সেই ৪২টা পদক এবার নিয়ে আসতে পেরেছে এইসব কারণের জন্য।” তাছাড়া রুদ্র প্রতিমের বৈজ্ঞানিক ট্রেনিং আছে। যা এসিসিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ দেখাতে পেরেছে।
মেঘাদ্রি সাহা।
চ্যাম্পিয়ন দল ইস্টবেঙ্গলের কোচ হলেন রুদ্রপ্রতিম রায়। “ইস্টবেঙ্গলের আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ। প্রতিটি ইভেন্টে কোনও না কোন প্রতিনিধি রেখেছে। তাছাড়া দুজন করে ছেলে-মেয়ে ফিজিও সারাক্ষণ মাঠে ছিল। ক্লাবের পক্ষ থেকে বারবার আমার কাছে এসে জানতে চেয়েছে, কিছু লাগবে কিনা। একটা দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গেলে যা যা করার প্রয়োজন সেটাই করেছে ইস্টবেঙ্গল। যারজন্য তারা বাংলার সেরা দল হয়েছে।” সব দলে নামা অ্যাথলিটরা এসিসিতে নিয়ে আসতে পেরেছে ২৯৫ পয়েন্ট। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে এসিসি থেকে নেমেছিলেন ৬জন। প্রত্যেকে পদক পেয়েছেন। ৫টা করে সোনা-রুপো ছাড়াও একটা এসেছে ব্রোঞ্জ। তারমধ্যে সিনিয়র স্তরে নামা তিনজন অ্যাথলিট রেকর্ড গড়েছেন। এবার এসিসি থেকে যাওয়া শতায়ু মন্ডল রাজ্যের দ্রুততম পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। সেই শতায়ুকে নেওয়ার জন্য মোহনবাগানকে বলা হয়েছিল। কিন্তু মোহনবাগানের পক্ষ থেকে না করা হয়। এরিয়ান্সে গিয়ে সেই শতায়ু হলেন কিনা বাংলার সেরা। মোহনবাগান কেন পারল না তার কারণ তুলে ধরতে গিয়ে রুদ্রপ্রতিম বলছিলেন, “অন্যান্যবার মোহনবাগান অনেকটা গুছিয়ে নামতো। এবার দেখলাম প্রচন্ড ঢিলেঢালা মনোভাব নিয়ে এগোচ্ছে। সেই তাগিদটা ছিল না। অতীতে দেবাশিস বন্দে্যাপাধ্যায় নিজে এসে সবকিছু দেখাশোনা করতেন। তঁাকেও এবার সেভাবে দেখিনি।” জোটের ভবিষ্যত্্ পরিণাম কি শুরু হয়ে গেল?