সরকারিভাবে সিলমোহর পড়েনি। প্রশ্ন অনেক আগেই উঠে গিয়েছে। কবে ব্যাট তুলে রাখবেন। উত্তর যিনি দেবেন, সেই মহেন্দ্র সিং ধোনি মুখ ঘুরিয়ে টানা খেলে চলেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায় নিলেও আইপিএল থেকে সরে দাঁড়াতে পারেননি। তাই ২০২৫ আইপিএল মরশুমেও তাঁকে খেলতে দেখা যাচ্ছে। তবে এটাই সম্ভবত শেষ মরশুম। টুর্নামেন্ট শেষ করে বাড়়ি ফিরে কিছুদিন সময় নেবেন। তারপর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন।
এটাই কি সরে দাঁড়াবার সেরা সময়! না, সেই সময় অনেকদিন আগে পার করে এসেছেন ধোনি। ২০২৩ এর ২৮ মে আইপিএল ফাইনালে গুজরাট টাইটান্সকে পাঁচ উইকেটে হারানোর পর পুরস্কার মঞ্চে তাঁকে প্রথমেই প্রশ্ন করা হয়েছিল, এবারই কি অবসরের কথা জানিয়ে দেবেন! ধোনি বলেছিলেন, এই সিদ্ধান্ত এখন নিত ভল হত। কারন এটই সেরা সময়। কিন্তু তা আর পারছি কোথায়! পরের মরশুম শুরু হতে এখনও আটমাস বাকি। সময় নিয়ে ভাবব। তারপর জানিয়ে দেব।
ধোনি কিছুই জানাননি। পরের আইপিএল শুধু নয়, তিনি এবারও আইপিএল খেলছেন। টুর্নামেন্টে সিএসকের জঘনয পারফরম্যান্সের পর প্রশ্ন উঠেছে ধোনি কি সামনের মরশুমেও খেলা চালিয়ে যাবেন! সিএসকের এখনও পাঁচ ম্যাচ বাকি। এখনই এ নিয়ে কথা বলবেন না। কিন্তু যা শোনা গিয়েছে সামনের মরশুমে ক্রিকেট ব্যাট হাতে ধোনিকে বইশশ গজে দেখা যাবে না। হয়তো সিএসকের হয়ে কোনও কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখবেন। কিন্তু ক্রিকেটার ধোনির সম্ভবত এটাই শেষ বছর।
এবারের মরশুমে নটি ম্যাচের মধ্যে মাত্র দুটি জিতেছে সিএসকে। কেন এমন হল। সোজাসুজি বলা যায় যে তারা এবার মোটেও ভাল দল তৈরি করতে পারেননি। অকশন থেকে তেমন ক্রিকেটারও নিতে পারেননি। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। এ নিয়ে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। কারন ধোনি মানে সিএসকে। আর সিএসকে মানে ধোনি। দলের প্রথম ও শেষ কথা তিনিই বলেন। কাক রাখা হবে, কাকে বাইরে পাঠানো হবে, এসব সিদ্ধান্ত ধোনির। তাাই দলের ব্যর্থতার দায়ও তাঁকে নিতে হবে। স্পটাররা সারা বছর দেশের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে ঘুরে কয়েকজন ক্রিকেটার দলে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু তাদের উপর ভরসা রাখতে পারছে না ম্যানেজমেন্ট। ওপেনার শেখ বা মাত্রেকে শেষদিকে দলে আনা হল। তাদের আগে থেকে খেলিয়ে কেন তৈরি করা গেল না। আসলে সিএসকে সবসময় সিনিয়র ক্রিকেটার নিয়ে খেলতে ভালবাসে। তাদের ট্র্যাকরেকর্ড দেখলে সেটা ধরা পড়ে যাবে। যে দলে বিজয় শঙ্কর, ত্রিপাঠি বা অশ্বিনের মতো ক্রিকেটার এখনও খেলে চলেছেন, তাদের উপর কে ভরসা করবে। দলের সমস্যা বাড়িয়ে দিল অধিনায়ক ঋতুরাজ গায়কোয়াডের চোট। তিনি হঠাৎ করে টুর্নামেন্টের বাইরে চলে যাওয়ায় সিএসকের ব্যাটিংয়ে বড় ধাক্কা খেল। আগের বছরগুলিতে ডেভন কনওয়ের সঙ্গে ওপেন করতেন ঋতুরাজ। এবার তাঁকে তিনে নিয়ে আসা হল। কেন! ত্রিপাঠিকে তাঁর আগে জায়গা করে দেওয়া হল। বলা হল, মিডলঅর্ডারের দায়িত্ব নেবেন ঋতুরাজ। শুরুটা ভালই করেছিলেন সিএসকে অধিনায়ক। কিন্তু চোট তাঁকে ছিটকে দিল। একইসঙ্গে চাপে ফেলে দিল দলকে। দলে আর কোনও ব্যাটসম্যান ছিলেন না যিনি দায়িত্ব নিয়ে দলকে টানবেন। এমন দল গড় কেউ কি সাফল্যের মুখ দেখতে পারেন। সিএসকে তাই পায়নি।
এসবের বাইরে আরও একটি কারন আছে। ধোনি কখনও সাতে তো কখনও আটে। আবার কখনও নয় নম্বরে ব্যাট করতে নামছেন। এটা কি অধিনায়কের কাজ। তাঁকে দেখে দলের বাকিরা ছুটবেন। সেটাই হচ্ছে না। ভাবা যায়, এমন দিনও গিয়েছে যে ধোনির আগে ব্যাট হাতে নেমে পড়েছেন অশ্বিন। কেন! ধোনিই জানেন তিনি কি করতে চাইছিলেন। আগ অধিনায়ক ছিলেন না বলে মিডিয়ার সামনে আসার রকার পড়েনি। কিন্তু ঋতুরাজ বাইরে চলে যাওয়ার পর তিনি অধিনায়কের দায়িত্ব নিতে আবার সামনে চলে এলেন। প্রত্যেক ম্যাচের শেষে পুরস্কার মঞ্চে তাঁকে আসতে হচ্ছে। সেখানে এই প্রশ্নগুলি উঠে আসছে। এটা তো মেনে নেওয়াও সম্ভব নয়। ব্যর্থতার দিনে কি আর কথা বলবেন। যিনি সব কিছু করেছেন, তিনি কি তাঁর নিজের ভুল ধরবেন।
জাতীয় দলের দায়িত্বে থাকার সময় অনেক কিছু করেছেন। সাফল্যও পেয়েছেন। ২০০৭, ২০১১ বিশ্বকাপ জিতেছেন। ২০১৩ চ্যম্পিয়ন্স ট্রফিও তাঁর পকেটে। ক্রিকেট সব কিছু দিয়েছে। এখনও মাঠে ব্যাট নিয়ে নামলে কেড়েও নেবে ক্রিকেট। ব্র্যাডম্যানকে চার রান করতে দেয়নি ক্রিকেট। করতে পারলে গড় ১০০ হত। কিন্তু তা তিনি করতে পারেননি। জীবনের শেষ ইনিংস ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছেন। ধোনির জীবনেও তেমন কিছু হতে চলেছে। দুবছর আগে ক্রিকেট ছেড়ে দিলে চ্যাম্পিয়নের মুকুট মাথায় তুলে ফিরতে পারতেন। এখন ব্যর্থতার কাঁটা নিয়ে তাঁকে ছাড়তে হবে। এটা কি ধোনির মতো ক্রিকেটারের পক্ষে মানায়।
ধোনি সেদিন বলেছিলেন, চেন্নাইয়ের মানুযের ভালবাসা তাঁকে মাঠে টেনে নিয়ে আসে। গ্যালারি থেকে ধোনির নাম ধরে চিৎকার তাঁর চোখ ভিজিয়ে দেয়। সব ঠিক আছে। কিন্তু এবার সেই গ্যালারি থেকে ধোনি বলে চিৎকার শোনা যাবে না। বলবে, একজনের জায়গা ধোনি আটকে রেখেছেন। সেটা কি শুনতে ভাল লাগবে! তাই অনেক হয়েছে। এবার মান থাকতে সরে দাঁড়ানো ভুদ্ধিমানের কাজ হবে। এতদিন খেললেন। এবার ক্রিকেটার গড়ার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। সেটাই বা কম কিসের। এতেও মানুষের ভালবাসা তিনি একইভাবে পাবেন। আসলে বাইশ গজ ছাড়তে কেউ চান না। সে শচীন তেন্ডুলকরও নন। বাধ্য হয়েছিলেন সরে দাঁড়াতে। যাঁরা তা পারেন তাঁরা এদিক থেকেও মহান হন। ধোনি তাই বাড়ি ফিরে কিছুদিন সময় নিয়ে সরে যাওয়ার কথা জানিয়ে দেবেন। যেমন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে একটার একটা ফরম্যাট থেকে সরে গিয়ে ক্রিকেটপ্রেমীদের চমকে দিয়েছিলেন, তেমনভাবে এই আসর থেকেও সরবেন। তবে এই ঘোষণায় মানুষ কিন্তু চমকে উঠবেন না।