বহুদিনের লালায়িত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে চলেছে আইএফএ। রাজ্য ফুটবল সংস্থা অথচ তার নিজস্ব কোনও অ্যাকাডেমি নেই। এই বদনাম বহুদিন ধরেই শুনতে হচ্ছিল আইএফএ-কে। এবার সেই বদনাম ঘুচিয়ে ফেলতে আগ্রহী রাজ্য ফুটবল সংস্থা। নদীয়ার পলাশিতে হতে চলেছে আইএফএ-র ফুটবল অ্যাকাডেমি। কিছুদিনের মধ্যে তা উদ্বোধন হয়ে যাবে। মাঠ, পরিকাঠামো সব প্রস্তুত। এখন চলছে শেষ তুলির টান। তেমনই জানালেন নদীয়া জেলা সভাধিপতি তারুন্নুম সুলতানা। মূলত তঁার উদ্যোগে মরুভূমির বুকে মরুদ্যানের সঞ্চার ঘটবে।
পলাশি বলতে আমরা বুঝি, ভারতীয় স্বাধীনতার সূর্যাস্তের শুরু। যে যুদ্ধের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল ইংরেজদের ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস করার অধিকার অর্জন। সেখান থেকে জিতে এবার জেলা সভাধিপতি হয়েছেন তারুন্নুম সুলতানা। ২০১৬-১৭ সালে মাইনোরিটি সম্প্রদায়ের জন্য একটা স্পোর্টস কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়। নামেই তৈরি হলেও কাজের কোনও প্রতিফলন ছিল না। স্রেফ ইঁট, পাথর, সুড়কির সমাবেশে কয়েকটা বিল্ডিং তৈরি হয়ে পড়েছিল। কিন্তু নতুন সভাধিপতি হয়েই তাতে হাত লাগান তারুন্নুম। কীভাবে ফুটবল অ্যাকাডেমি গড়া যায় তারজন্য চেষ্টা চালাতে থাকছিলেন। কিন্তু বাস্তবে প্রতিফলিত হচ্ছিল না। সেই সময় ধূমকেতুর মতো উদয় হন অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। আইএফএ-র প্রেসিডেন্ট হিসেবে কৃষ্ণনগরের একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে যায়। তারুন্নুম ম্যাডাম প্রস্তাব দিতেই তাকে লুফে নেন অজিত বন্দে্যাপাধ্যায়। শুরু হয়ে যায় কাজ। “কৃষ্ণনগরের অনুষ্ঠানে আমিও গিয়েছিলাম। সেখানেই অজিতদাকে বলতে তিনি খুব আগ্রহী হন। তারপর আইএফএ সচিব অনির্বাণ দত্ত বেশ কয়েকবার এসে দেখে গিয়েছেন। সবকিছু দেখে তিনিও দারুন খুশি।” আপ্লুত কন্ঠে বলছিলেন তারুন্নুম। অ্যাকাডেমির জন্য আইএফএ-র সঙ্গে নদীয়া জেলা পরিষদের মৌ সাক্ষর হয়ে গিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা মাঠে এখন চলছে পরিচর্যার কাজ। স্টেডিয়াম সংলগ্ন একটা মাঠ থাকলেও আশেপাশে রয়েছে বহু মাঠ। “ওই অঞ্চলটা বলতে পারেন খেলা পাগল। বিশেষ করে শীতকালে প্রচুর টুর্নামেন্ট হয়। এমন কী টিকিট কেটে ৭-১০ দিন ধরে চলে ফুটবল প্রতিযোগিতা। বিশ্বাস করবেন না, বহু খেলা পাগল মানুষ ওখানে আসেন খেলা দেখতে। যখনই ডাক পাই তখনই চেষ্টা করি ছুটে যেতে।” কথাবার্তায় ফুটে উঠছিল ক্রীড়াপ্রেমী তারুন্মুমের নানান দিক। কী নেই সেখানে? মাঠ থেকে গ্যালারি, ক্যান্টিন থেকে থাকার ঘর। সবকিছু এক ছাতার তলায় পাওয়া যাবে। “বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, জেলা সভাধিপতি হওয়ার পর আমি প্রথমেই ঠিক করেছিলাম, পলাশির ওই মাঠকে কাজে লাগাব। শুধুমাত্র যোগাযোগের অভাবে একটা পরিকাঠামোকে কখনও ধ্বংস করা যায় না। আমি একটা জিনিস বুঝি, যদি কাজে নিষ্ঠা থাকে, লক্ষ্য স্থির রাখা যায়, তাহলে যত কঠিন কাজই হোক না কেন, সফল মানুষ হবেই।” বলছিলেন নদীয়া জেলার সভাধিপতি।
যে কোনও প্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে প্রথমেই প্রয়োজন হয় অর্থ। এই দিকটাও ঠিক করে রেখেছেন তারুন্নুম ম্যাডাম। ইতিমধ্যে মাইনোরিটি ডিপার্টমেন্টে সাহায্যের আবেদন করা হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া প্রাথমিক স্তরে যে অর্থের প্রয়োজন তা জোগাচ্ছে নদীয়া জেলা পরিষদ। নামকেওয়াস্তে অ্যাকাডেমি গড়তে আবার তিনি রাজি নন। তাই আইএফএকে জানিয়েছেন, বিদেশি কোচ আনতে হবে। এখানে প্রশিক্ষণ দেওয়া ফুটবলারদের নিয়ে যেতে হবে কলকাতায় খেলতে। সেখান থেকে ছড়িয়ে দিতে হবে ভারতবর্ষের বিখ্যাত ক্লাবগুলোতে। তাই বলে এই অ্যাকাডেমিতে কেবলমাত্র নদীয়ার ছেলেরাই সুযোগ পাবে তা চাইছেন না তিনি। তঁার মতে, “নদীয়া জেলায় অ্যাকাডেমি হচ্ছে বলে, কেবলমাত্র আমাদের জেলার ছেলেদের সুযোগ দিতে হবে তা কখনও হতে পারে না। ফুটবলার বাছাইয়ের নানান পদ্ধতি নিশ্চয় আছে। সেই পদ্ধতি মেনে আমাদের জেলার যে কজন সুযোগ পাবে তা মেনে নিতে হবে।” অকপট স্বীকারোক্তি তারুন্নুম ম্যাডামের। পর্দানসীন, শিক্ষায় অনগ্রসর, আধুনিকতার মোড়কে ঢাকা নয়, এভাবে কতই না বলা হয় মুসলিম সম্প্রদায় মহিলাদের। কিন্তু তারুন্নুম সমস্ত প্রতিকূলতার পর্দাকে সরিয়েছেন তাই নয়, বুঝতে শিখেছেন কীভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়া তরুন সমাজকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসতে হয়। তাইজন্য ইতিহাসে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট হওয়া মহিলা বলছিলেন,“এমনিতেই আমি খেলাধূলোকে ভালোবাসি। তার উপর আমার প্রথম থেকে লক্ষ্য ছিল, তরুন সমাজকে বর্তমান ধ্বংসের হাত থেকে বঁাচানো। ক্রমাগত মোবাইল, আড্ডা, বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে মাঠে আসার প্রয়োজনীয়তাকে এরা ভুলে গিয়েছে। সেইজন্য বর্তমান প্রজন্মকে মাঠমুখো করার জন্য আমার এই উদ্যোগ।” কাল যদি জেলার দায়িত্বে না থাকেন তাহলেও অ্যাকাডেমি বন্ধ হতে দেবেন না তিনি। “আমি জানিনা পরবর্তী জেলার দায়িত্বে যিনি আসবেন তিনি আমার সঙ্গে সহমত হবেন কিনা। যদি নাও হন তাহলেও অ্যাকাডেমি বন্ধ হতে দেব না। যতদিন বেঁচে থাকব, এই অ্যাকাডেমি চালিয়ে যাব। তেমন ক্ষমতা আমার রয়েছে।” বেশ জোর দিয়ে কথাগুলো বললেন তিনি। বুঝিয়ে দিলেন, কারওর দিকে তাকিয়ে তিনি এই মহাযজ্ঞের প্রস্তুতি নিতে আসেননি। ডেভলাপমেন্ট বলতে শুধু আলো, রাস্তা, ঘর-বাড়ি তৈরি নয়। এমন কিছু করা যেখানে আগামী প্রজন্ম এরই আলোয় আলোকিত হতে পারে। তারুন্নুম তখন না হয় দূর থেকে রসস্বাদন করবেন।