শার্দুল ঠাকুরের বল মিড উইকেটের উপর দিয়ে মাঠের বাইরে ফেলে তিনি যেন এই বার্তাই দিলেন- স্যর এবার আপনি হোটেলে যান।
তিনি মানে লোকেশ রাহুল। একবছর আগে লখনউয়ের একানা স্টেডিয়ামে হায়দরাবাদের কাছে বিশ্রিভাবে হারার পর মাঠের মধ্যেই অধিনায়ক রাহুলকে এক হাত নিয়েছিলেন দলের অন্যতম কর্ণধার সঞ্জীব গোয়েঙ্কা। তাঁর চোখ, মুখের ভাষায় মনের ছবি পড়ে নেওয়া গিয়েছিল। সেদিনের সেই ছবি স্যোশাল মিডিয়ায় ঝড় তুলেছিল। তারপর গোয়েঙ্কাকে সমালোচনায় বিদ্ধ করেছিলেন ক্রিকেটপ্রেমীদের সঙ্গে প্রাক্তন ক্রিকেটাররাও। পরে মিস্টার গোয়েঙ্কা পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে মলম লাগাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু রাহুলের বুকে জমে থাকা ক্ষত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায় নাকি! মনে পুষে রেখেছিলেন। অপেক্ষায় ছিলেন কবে দিন আসবে। সুযোগ এলে সব কিছু মিটিয়ে নেবেন। অবশেষে দিন এল। সময়ও এল। সব কিছুর জবাব দিয়ে খেলা শেষে অন্য ম্যাচ জিতে বেরিয়ে এলেন।
অবাক করার বিষয় ছিল ম্যাচ শেষে দু সেকেন্ডের ঘটনাটি। রাহুলকে দেখে এগিয়ে এলেন মিস্টার গোয়েঙ্কা। সকলের সঙ্গে হাত মেলাবার সময় লখনউয়ের কর্ণধারের বাড়িয়ে দেওয়া হাতে হাত রেখে পাশে দাঁড়ানো অন্যজনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন রাহুল। এর থেকে বড় জবাব আর কি হতে পারে! এখানেই ম্যাচ শেষ করে দিলেন লখনউয়ের প্রাক্তন অধিনায়ক। দিনটার কথা মিস্টার গোয়েঙ্কাও নিশ্চয় ভুলতে পারবেন না। রাহুলের কাছ থেকে এমন পাল্টা কিছু পাবেন তিনি বোধহয় আশা করেননি। তবে ভুল তো কিছু করেননি রাহুল। সেদিনের ছবি সামনে এনে মঙ্গলবারের রাতের দৃশ্য পাশে রাখলে একটা কথাই বলতে ইচ্ছে করবে, মিস্টার গোয়েঙ্কা এখন কেমন লাগছে!
T
কম কথার মানুষ লোকেশ রাহুল। আসলে দক্ষিণ ভারতের ক্রিকেটাররা এমনই হন। সাধারণত তাঁরা বেশি কথা বলেন না। প্রায় সবাই শিক্ষিত বলে কোনটা ভাল বা কোনটা মন্দ তা সহজে বুঝতে পারেন। কোনও দল একটা ম্যাচ হারতেই পারে। তাই বলে ম্যাচ শেষে মাঠেই দলের অধিনায়ককে কড়া ভাষায় আক্রমন! এ কেমন কর্তা! এটা কি মেনে নেওয়া যায়!
তবে মিস্টার গোয়েঙ্কাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এমনটা সব ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকরাই করে থাকেন। ভাল হলে তোমার মতো কেউ হয় না। সকলের সামনে জড়িয়ে ধরে ছবি তোলার জন্য নানারকম পোজ দেন। হারলে উল্টো ছবি। সকলের সামনে দাঁড়িয়ে সমালোচনা। স্থান, কাল, পাত্র ভুলে যা খুশি তাই করেন। এমন করেন বলেই ক্রিকেটারদের কাছে কর্তারা কাছের হয় না। ক্রিকেটাররা জানেন, সুযোগ পেলে এঁরাই ছুরি মারবেন।
এবারের আইপিএলে লখনউয়ের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে রাহুল খেলেননি। প্রথম সন্তানের জন্মের সময় স্ত্রী-র কাছে থাকার জন্য ছুটি নিয়েছিলেন। কিন্তু এবার সরে গেলেন না। বিশেষ করে একানা স্টেডিয়ামেই খেলা বলে হয়তো নিজেকে দারুনভাবে মোটিভেট করতে পেরেছিলেন। ভেবে রেখেছিলেন, দারুন কিছু একটা করতে পারলে সব কিছু পুষিয়ে দেবেন। তিন নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ইনিংসকে গুছিয়ে নিলেন। সঙ্গী বাংলার অভিষেক পোডে়লকে বলেছিলেন, বাড়তি ঝুঁকি নিয়ে খেলার দরকার নেই। স্ট্রাইক রোটেড কর। অপেক্ষা কর। মারার বল পাবে। তখন মারবে। এসবই অভিষেকের কাছ থেকে শোনা। সেভাবে দুজনে খেলতে চেয়েছিলেন। জয়ের খিদে যেন বেশি ছিল রাহুলের। স্টেডিয়ামে মিস্টার গোয়েঙ্কার সামনে হারতে চাননি। পুরো ইনিংসকে গুছিয়ে নিয়ে টার্গেটের পিছনে ছোটার চেষ্টা করেছিলেন। অভিষেকের পর পেয়ে যান অধিনায়ক অক্ষর প্যাটেলকে। অক্ষরের দাপুটে ইনিংসকে সঙ্গী করে রাহুল এগিয়ে চলেন। মনে কতটা রাগ পুষে রেখেছিলেন তা বোঝা যায় হাফ সেঞ্চুরির পর। প্রথমে ব্যাট তুললেন না। তবে ব্যাট পিছনে নিয়ে জার্সিতে লেখা একনম্বরকে দেখাতে চাইলেন। তারপর ব্যাট তুললেন। এটাই রাহুলের জবাব।
৪২ বলে অপরাজিত ৫৭ রানের ( ৩টি বাউন্ডারি ও ৩টি ওভার বাউন্ডারি) ইনিংস খেলেও তিনি নির্বাক। মাঠে যা প্রমান দেওয়ার দিলেন। আর ভিআইপি বক্সে বসে মিস্টার গোয়েঙ্কা দেখলেন, বোলারদের পিটিয়ে রাহুল কীভাবে ম্যাচ জিতে নিলেন। এটাই জবাব। সেটা দিতে পেরে রাহুল তৃপ্ত। খেলার শেষে তাঁকে বেশ শান্ত লাগল। মানসিক শান্তি বলতে যা বোঝায়, অনেকটা তেমন। আর মিস্টার গোয়েঙ্কা। সব কিছু কি মেনে নিতে পারলেন। তারপর তো শেষের ঘটনা। যেখানে রাহুল পাত্তা না দিয়ে সরে গেলেন। সত্যি এটা হজম করা সহজ নয়। একবছর আগে রাহুল যেমন সব কিছু মেনে চুপ ছিলেন। সেটাও তো হজম করা কঠিন ছিল। মিস্টার গোয়েঙ্কা রাতে ভাল করে ঘুমোতে পেরেছেন তো!
সবশেষে, একটা কথা বলে রাখি। এমনদিন আসতে পারে, মিস্টার গোয়েঙ্কা কি আগেভাবে আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। অস্ট্রেলিয়া মাটিতে টেস্ট সিরিজ বা দুবাইয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে রাহুলের পারফরম্যান্স দেখার পর তিনি কি পড়ে নিতে পারেননি এবার পাল্টা জবাব আসতে পারে। তিনি কি দলের ক্রিকেটারদের বলেছিলেন, আমি শুধু এই ম্যাচ জিততে চাই। এটা তোমরা আমাকে উপহার হিসেবে দাও। মনে হয় না এমন কথা তিনি বলেছেন। তাই হয়তো কষ্টটা তাঁর বেশি।