“রবিবার রাতে ফিরে আসায় সেভাবে সেলিব্রেশন করা হয়নি। সোমবার রাতে বাবা বিরিয়ানি নিয়ে আসবেন বলেছেন। অনেকদিন খাইনি। তাই বিরিয়ানি খাব।” কথাগুলো হাস্যচ্ছলে একটানা বলে গেলেন শতায়ু মন্ডল। যিনি ২৪ ঘন্টা আগে রাজ্য অ্যাথলেটিক্স মিটে ১০.৮ সেকেন্ডে ১০০ মিটার দুরত্ব অতিক্রম করে বহুদিন পরে বাংলার স্প্রিন্ট ইভেন্টে হইচই ফেলে দিয়েছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, ২০১৮ সালে সফিকুল মন্ডলের পর আবার একজন উঠে আসছেন যিনি পারেন জাতীয় স্তরে নিজেকে তুলে ধরতে।
পুরোপুরি অ্যাথেলিটক্স পরিবার। রীনা দেবনাথ মন্ডল হলেন একজন আন্তর্জাতিক অ্যাথলিট। একসময় লংজাম্পে ভারত কঁাপিয়েছেন। বাবা বরুণ মন্ডল ছিলেন অ্যাথলিট। বাবার টান ছিল স্প্রিন্ট ইভেন্টের প্রতি। সেই সূত্রে যে ছেলেকে একই জায়গায় টেনে এনেছেন তা কিন্তু নয়। অ্যাথলেটিক্সে ছেলে এসেছে ভাগ মিলখা ভাগ সিনেমা দেখে। “ক্লাস এইটে পড়ার সময় প্রথমে সোমা দির (বিশ্বাস) অধীনে সাইতে ভর্তি হই। কিছুদিনের মধ্যে তিনি সাই ছেড়ে চলে গেলেন। তারপর যাই কল্যাণ স্যারের কাছে। তিনিও ট্রান্সফার হয়ে চলে গেলেন। পরে যোগ দিই কুন্তল রায়ের কোচিংয়ে। কিন্তু স্যারের কাছে এক বছর থাকার পরে চলে আসি তঁার ছেলে রুদ্রদার কাছে। সেই থেকে বলতে পারেন রুদ্রদার কাছেই আছি। তাও প্রায় বছর পঁাচ-সাত হয়ে গেল।” বলছিলেন শতায়ু। স্প্রিন্ট ইভেন্টে আসার রহস্য নিজেই উন্মোচন করলেন। “টিভিতে দেখতাম, স্প্রিন্ট ইভেন্টগুলো খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। সকলে এই ইভেন্ট দেখার জন্য মুখিয়ে থাকে। উসেইন বোল্ট যেন আমার চোখ খুলে দিল। দেখে মনস্থির করে ফেললাম, আমি স্প্রিন্ট ইভেন্ট ছাড়া আর কিছু করব না। জানি, এই ইভেন্ট কতটা কঠিন। আমি খুব জেদী। তাই যা করব ভাবি তাই করবার চেষ্টা করি। সেই কারণে স্প্রিন্ট ইভেন্টে চলে এসেছি। অনেকে বলেছেন, আমাকে চারশো বা লং ডিসটেন্স রানে দিতে। ওই যে বললাম, জেদ।” বলছিলেন শতায়ু।
জাতীয় মিটের ফাইনালে ওঠার স্বপ্ন নিয়ে ঝঁাপাতে চান শতায়ু।
কোনওদিন রাজ্য মিটে পদক পাওয়া দূরে থাক, ফাইনালে উঠতে সেভাবে পারছিলেন না। ২০২২ সালের পর থেকে ফাইনালে ওঠা শুরু হয়। এবার তো বাজিমাত। “আমি এবার ঠিক করেছিলাম, ফাইনালে উঠে পদক আনতে হবে। ২০২৩ সালে মন থেকে কেমন যেন ভেঙে পড়েছিলাম। তবু মনকে সায় দিই, ছাড়ব না। চালিয়ে যেতে হবে। সেই কারণে ঝঁাপিয়ে ছিলাম। ২০২৫ সালের শুরু থেকে টার্গেট করি যেভাবে হোক এবার পদক আনা চাই। তারজন্য যাবতীয় জাঙ্ক বা ফাস্ট ফুড খাওয়া ছেড়ে দিই। প্র্যাকটিশে ১০.৫-৬ সেকেন্ডে দৌড়চ্ছিলাম। তাই আশা ছিল কিছু একটা করতে পারব। সেই কারণে জেদ চেপে গিয়েছিল। তাছাড়া গত কয়েকমাস রুদ্রদা আমাকে যেভাবে থাকতে বলেছেন সেইভাবে থেকেছি। জানতাম জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হবে।” ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন অ্যাথলেটিক্স ছাড়া আর কিছু ভাবতে নারাজ। এবার তঁার লক্ষ্য হল ১০.৫ সেকেন্ডে নিজেকে নিয়ে আসা। তারমানে ০.৩ সেকেন্ড কমানোর জন্য নিজেকে সঁপে দিতে চান। সেই কারণে শতায়ু বলছিলেন, “১০.৫ সেকেন্ডের লক্ষ্যে যদি ঢুকে পড়তে পারি তাহলে আমার মনে হয়, ১০.৩-তে চলে আসতে অসুবিধে হবে না। এবার আমার একটাই লক্ষ্য জাতীয় মিটে ফাইনালে ওঠা। বিশ্ববিদ্যালয় মিটে তিনবার নেমেছি। একবার অনূর্ধ্ব-২৩ বিভাগে নেমেছি। কোনওবার ফাইনালিস্ট হতে পারিনি। তাই এবার শপথ নিয়েছি, যেভাবে হোক আমাকে ফাইনালে উঠতে হবে।” ২০ জুলাই জাতীয় ওপেন মিটে নামবেন। অক্টোবরে আছে অনূর্ধ্ব-২৩ মিট। এই দুটো মিটে ভাল কিছু করার লক্ষ্য নিয়ে এগোতে চান শতায়ু। বোন জিনিয়া মন্ডলও এখন রাজ্য স্তরে সাড়া জাগানো একজন অ্যাথলিট। এবার অনূর্ধ্ব-১৮ বিভাগে ২০০ মিটারে ব্রোঞ্জ, ৪০০ মিটারে রুপো ও ৪০০ মিটার রিলেতে রুপো পেয়েছেন। ১০০ মিটার রিলেতে রুপো পেয়েছেন জাতীয় স্কুল মিটে। এখন বিপিএড করছেন শতায়ু।
জিনিয়াও এখন জুনিয়র স্তরে নজরকাড়া অ্যাথলিট।
“অনেকে জন্মগত প্রতিভার শরিক হয়। আবার অনেকে শ্রেষ্ঠত্বের জায়গায় পৌছয় পরিশ্রমের দ্বারা। সত্যি বলতে কী শতায়ু হল দ্বিতীয় শ্রেণীর অ্যাথলিট। যদি এই ছেলেটা নিজেকে ঠিকমতো ধরে রাখতে পারে তাহলে কিন্তু অনেকদূর যাবে। পরিশ্রম করার পাশাপাশি ত্যাগ করতে জানে। গত কয়েকমাস কিচ্ছু খায়নি। অ্যাথলেটিক্সের প্রতি ছেলেটার ত্যাগ করার প্রচন্ড ইচ্ছে রয়েছে। তাই বলতে পারি, একে নিয়ে স্বপ্ন দেখা যেতেই পারে।” মূল্যায়ন করতে বসে জানিয়ে দিলেন দ্রোণাচার্য কুন্তল রায়। বারাসতের বিজয়নগরের ছেলেটাকে হয়তো অনেকে এখনও চেনেন না। শুধু প্রয়োজন প্রচন্ড ইচ্ছের সঙ্গে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার তাগিদ। তাহলে শুধু বারাসত নয়, হয়তো চিনে যাবে সারা দেশ। পারবেন শতায়ু, পারবেন। তঁাকে যে পারতেই হবে।